বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম - রচনা || Bangla Rachana Kazi Nazrul Islam
বাংলা রচনা/Bangla Rachana
কাজী নজরুল ইসলাম || বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম || Kazi Nazrul Islam
১.ভূমিকা.
২.জন্ম ও পারিবারিক জীবন.
৩.শিক্ষা ও শৈশব.
৪.নজরুলের সাহিত্যিক জীবন প্রকাশ.
৫.কাব্যসৃষ্টি বৈশিষ্ট্য.
৬.উপসংহার
ভূমিকাঃ-
বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। বিদ্রোহ ও তারুণ্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। একাধারে সাহিত্যিক, কাবি, ঔপন্যাসি, সঙ্গীতঞ্জ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনৈতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের, শোষণ -নির্যাতন আর দুঃখ দরিদ্রের বিদ্রোহী নজরুল ইসলাম সর্বদায় ছিল উচ্চকণ্ঠ।
আধুনিক বাংলা কাব্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম একেবারে ব্যতিক্রম প্রতিভা।বাংলা কাব্যের শান্ত পরিবেশে তিনি ঝড় তুলেছিলেন। বাংলা কাব্যের প্রেম ও সৌন্দর্যের স্তনগান থেকে সরে গিয়ে তিনি সমাজের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি বলিষ্ঠ কন্ঠেে ঘোষণা করলেন-
"আমি বিদ্রোহী ভৃগু,ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন, আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন"!
অসহায়, ক্ষুধার্ত দেশবাসী হয়ে তিনি লিখলেন -
"প্রার্থনা ক'রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ"
সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সর্বদায় সোচ্চার। তাই তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে "বিদ্রোহী কবি"আখ্যায়িত করা হয়েছে।
জন্ম ও পরিবারক জীবনঃ-
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১১ জৈ্যষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দেে,২৪ জুন১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে ভারত বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে তার জন্ম। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। তিন ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে তাদের অসচ্ছল সংসার। চরম অর্থনৈতিক আর দুঃখ দরিদ্র মধ্যেই তার বাল্যকাল কাট। কবি কাজী নজরুল ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। মাত্র নয় বছর বয়সে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বাবাকে হারান।
পিতার মৃত্যুর পর অভাব অনটন তার শিক্ষার পথে বাধা হয়ে দাড়ায়। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে তিনি তার বাবার কাছে থেকে পেয়েছিলেন উন্নত আদর্শ ও ধর্ম বিষয়ে উদারতা।
শিক্ষা ও শৈবালঃ-
চুরুলিয়া গ্রামের মৌলবি কাজী ফজল আহমেদর কাছে বিদ্রোহী কোভিদ প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল। যেমন তিনি মেধাবী ছিলেন তেমনি দুরন্তপনা ও ছিল তাঁর। ৯ বছর বয়সে পিতাকে হারানোর পর জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে ওই বয়সেই তাকে জীবিকার সন্ধান করতে হয়েছিল।
কিন্তু আর্থিক অভাব তার লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ কমাতে পারেনি। বাল্যকালেই তিনি কোরআন, রামায়ন,মহাভার, পুরাণ কাহিনী সবই পড়ে ফেলেছিলেন। আরবী, ফরাসি ভাষা আন্দোলন কে ও অনেকটা আয়ত্ত করেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিক্ষা জীবন শুরু হয় রানীগঞ্জের সিয়ারশোল স্কুলে। এরপর ভর্তি হন বর্ধমানের মাথরুন উচ্চ বিদ্যালয়।
এই সময় দারিদ্রতা তার শিক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অভাবের তাড়নায় ছেড়ে দিতে হয় পড়াশোনা। এরপর যুক্ত হন কবি গানের দলে। এই সমস্ত গানের দলে লেটোর দল বলা হয়। এখানে তিনি নিজেই গান লিখতেন এবং সুর দিতেন।
এসময় তিনি অনেক সাধারন মানুষ, সুফি, ফকির, বাউল, সাধু সন্ন্যাসীদের সান্নিধ্য পান। পুনরায় ভর্তি হন রানীগঞ্জ অন্তর্গত সিয়ারসোল স্কুলে। তিনি যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। এরপর পড়া ছেড়ে বাঙালি রেজিমেন্টের যোগ দেন। সুদূর রাণাঙ্গনে সূচনা হয় তাঁর সৈনিক জীবন।
নজরুলের সাহিত্যিক জীবন প্রকাশ ঃ-
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হবার পর কলকাতায় ফিরে এসে নজরুল পুরোপুরি সাহিত্য বিকাশ করেন। এ সময় ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলছে। এ সময় স্বদেশে ফিরে আসে নজরুল। তার জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। যুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতি তার চেতনায় নিয়ে আসে এক পরিনিতি।
তিনি অনুভব করতে পারেন পরাধীনতার অপমান। যুদ্ধচলাকালীন তিনি লিখেছেন "বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী এবং রক্তের বেদনায়"নাম দুইটি উপন্যাস। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বাংলা কাব্য সাহিত্যের জগতে নিয়োজিত করেন।বুঝতে পারলেন কবিতা আর গান অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার ও নিজের প্রতিভা প্রকাশের উপযুক্ত অন্যতম মাধ্যম।
এই সময় বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো অন্যান্য সবাইকে আড়াল করে রেখেছিলে। কিন্তু বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার লেখার মাধ্যে এমন এক নবীনতাকে নিয়ে এলেন যে বাঙালি পাঠকগণ তাঁকে সংগ্রহে বরণ করে নিলেন।
কাব্যেসৃষ্টির বৈশিষ্ট্যঃ-
"মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিব না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ,ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।"
১৯২২ খ্রিস্টাব্দে "মুসলিম ভারত" পত্রিকায়" বিদ্রোহী" কবিতাটি প্রকাশিত হয় যা সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ করে। উক্ত কবিতাই বাংলা কাব্যে তাকে বিজয়ীর গৌরব সম্মান দান করল। বাংলায় এমন করে কবিতা আর কেউ কখনও লিখিননি।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ ই আগস্ট নজরুল "ধূমকেতু" পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। ওই বছরেরই ২৩ ই শে নভেম্বর তার প্রবন্ধ গ্রন্থ "যুগবানি "ইংরেজি সরকার বাজেয়াপ্ত করে।
সেদিন তাকে কুমিল্লা থেকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। কারাগারে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি আমরণ অনশন শুরু করেন। পরে রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে অনশন প্রত্যাহার করেন পাশাপাশি তাঁর সৃষ্টি ধরা অব্যাহত ছিল । একে একে প্রকাশিত হয় অগ্নিবীণা, দোলনচাঁপা, ভাঙ্গা গন, বিষের বাঁশি, সর্বহারা, ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ। একই সাথে তিনি অজস্র গান লিখেছিলেন ও সুর দিয়েছিলেন।
উপসংহারঃ-
বিদ্রোহী কবি যখন সকল সাধনার ঊর্ধ্বে তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে একটি অনুষ্ঠানে তিনি অসুস্থ হয়েপড়েন। তার বাকশক্তি হারিয়ে যায়। হারানোর বাকশক্তি তিনি আর ফিরে পাননি। জানা যায় কবি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরও তাকে সুস্থ করা যায়নি। অবশেষে এলো চিরবিদায়ের পালা। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ২৯ ই আগস্ট সতাওর বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার মৃত্যুতে দেশের আপামর জনসাধারণ শোকে অভিভূত হয়ে পড়ে।
"মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই"
তাঁর গানের লাইন অনুসরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁকে সমাহিত করা হয়। জীবনে কবি অসংখ্য খেতাব ও পুরস্কার পেয়েছে সে সঙ্গে শুনেছেন প্রশান্তি ও নিন্দাবাদ। সেসব ছড়িয়ে বাংলা কাব্য ও সঙ্গীতের জগতে তার স্থান আজও অম্লান হয়ে আছে।
No comments: